Untitled design 23

লোকসভা ভোটপর্বের মধ্যেই ঘোষিত হল রাজ্যে সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে আলোড়ন ফেলা মামলা ‘নিয়োগ দুর্নীতি’র রায়। সোমবার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শাব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৬ সালের এসএসসির সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে দিয়েছে। ২৮২ পাতার এই রায়ের ফলে শিক্ষক পদের পাশাপাশি গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি মিলিয়ে বাতিল হয়েছে মোট ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের চাকরি। রায় ঘোষণা করতে গিয়ে বিচারপতি বসাকের মন্তব্য, ‘‘এ ছাড়া (চাকরি বাতিল করা) কোনও উপায় ছিল না।’’

কলকাতা হাই কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হবে বলে সোমবারই জানিয়েছেন এসএসসির চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল এসএসসি নিয়োগ মামলার রায়কে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়েছে। কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে যে শিক্ষকেরা চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার রায়গঞ্জের জনসভা থেকে জানান, আদালতের সোমবারের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চ আদালতে যাবেন তিনি। এই রায়কে ‘বেআইনি’ বলেও দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী। অন্য দিকে, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ‘অতিরিক্ত শূন্যপদ’ (সুপার নিউমেরিক পোস্ট) সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেওয়া রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের গ্রেফতার করে জেরার দাবি তুলেছেন।

দুই বিচারপতির বেঞ্চ সোমবার জানিয়েছে, এসএসসি প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের সুদ-সহ বেতন ফেরত দিতে হবে। সুদের হার হবে বছরে ১২ শতাংশ। চার সপ্তাহের মধ্যে বেতন ফেরত দিতে বলেছে আদালত। এসএসসির নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনেক ওএমআর শিট বা উত্তরপত্র স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে ইতিমধ্যে আপলোড করা হয়েছে। যেগুলি এখনও আপলোড করা হয়নি, সেগুলি দ্রুত আপলোড করার নির্দেশও দিয়েছে দুই বিচারপতির বেঞ্চ। জানিয়েছে, উত্তরপত্র জনগণ যাতে দেখতে পান, সেই ব্যবস্থাও করতে হবে কমিশনকে।

একই সঙ্গে আদালত জানিয়েছে, এই মামলার তদন্ত চালিয়ে যাবে সিবিআই। অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরির জন্য চাইলে সন্দেহভাজনদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে কেন্দ্রীয় সংস্থা। সকলের চাকরি বাতিল করা হলেও এক জনের চাকরি থাকছে। সোমা দাস নামের এক চাকরিপ্রাপক ক্যানসারে আক্রান্ত। মানবিক কারণে তাঁর চাকরি বাতিল করেনি বিচারপতি বসাক এবং বিচারপতি রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ।

প্রসঙ্গত, গত তিন বছরে বাংলার রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোড়ন তোলা বিষয় নিয়োগ ‘দুর্নীতি’ মামলা। স্কুলে শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে বহু অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। টেট (প্রাথমিক স্কুল) এবং এসএসসি-র (মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক) দুই ক্ষেত্রেই রয়েছে অভিযোগ। টেট মামলা আপাতত সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। সোমবার এসএসসির চাকরি বাতিলের মামলার রায় ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট। ২৮২ পাতার রায় আদালতে পড়ে শোনান বিচারপতি বসাক।

এই মামলায় প্রথমে হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ডিভিশন বেঞ্চেও সেই নির্দেশ বহাল থাকে। এর পর মামলা গিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। সেখান থেকে মামলাগুলি হাই কোর্টে আবার ফেরত পাঠানো হয়। মে মাসের মধ্যে হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চকে শুনানি শেষ করে রায় ঘোষণা করতে বলেছিল শীর্ষ আদালত। সাড়ে তিন মাসের মধ্যে শুনানি শেষ হয়ে গিয়েছে। সোমবার রায় ঘোষণা করল দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ।

হাই কোর্টের রায় কী কী জানাল?

২৮২ পাতার রায়ে মূলত ছ’টি বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ।

প্রথমত, ২০১৬ সালে এসএসসিতে শিক্ষক, গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডিতে নিয়োগের পুরো প্যানেল বাতিল হবে। অর্থাৎ, ২৫ হাজার ৭৫৩ জন চাকরি হারাবেন।

দ্বিতীয়ত, নতুন নিয়োগ কী ভাবে হবে তা-ও জানিয়েছে হাই কোর্ট। নির্দেশ দিয়েছে, এসএসসির ঘোষিত শূন্যপদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এসএসসি নতুন করে ওএমআর শিট পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে নিয়োগ শুরু করতে পারবে। লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে তারা ওই পুনর্মূল্যায়নের কাজ শুরু করতে পারবে। ‘ওপেন টেন্ডার’-এর মাধ্যমে ওই বরাত দিতে পারবে এসএসসি।

তৃতীয়ত, হাই কোর্ট জানিয়েছে, এসএসসির প্যানেলের বাইরে, মেয়াদ শেষের পরে এবং যাঁরা সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের সকলকেই জনগণের টাকা থেকে বেতন দেওয়া হয়েছে। চার সপ্তাহের মধ্যে সুদ-সহ সেই বেতন ফেরত দিতে হবে এই তিন শ্রেণির বেআইনি ভাবে চাকরি প্রাপকদের। বছরে ১২ শতাংশ হারে সুদসমেত টাকা ফেরত দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা টাকা ফেরত না দিলে কী করা হবে সে বিষয়েও স্পষ্ট নির্দেশিকা দিয়েছে দু’বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলাশাসককে ছ’সপ্তাহের মধ্যে বেতনের টাকা সুদ-সহ আদায় করার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। জেলা স্কুল পরিদর্শকেরা জেলাশাসককে জানাবেন ওই ব্যক্তি কত টাকা বেতন নিয়েছেন।

চতুর্থত, এসএসসিতে বেআইনি নিয়োগ করতে অনেক ‘অতিরিক্ত শূন্যপদ’ (সুপারনিউমেরিক পোস্ট) তৈরি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। রাজ্য সরকারই সেই অনুমোদন দিয়েছিল। সোমবার কলকাতা হাই কোর্ট জানিয়েছে, সিবিআই রাজ্য সরকারের সঙ্গে যুক্ত সেই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করবে, যাঁরা অতিরিক্ত পদ তৈরির অনুমোদন দিয়েছিলেন এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রয়োজনে ওই ব্যক্তিদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে কেন্দ্রীয় সংস্থা, জানিয়েছে আদালত।

পঞ্চমত, এসএসসির নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনেক ওএমআর শিট বা উত্তরপত্র স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে ইতিমধ্যে আপলোড করা হয়েছে। যেগুলি এখনও আপলোড করা হয়নি, সেগুলি দ্রুত আপলোড করার নির্দেশও দিয়েছে দুই বিচারপতির বেঞ্চ। জানিয়েছে, উত্তরপত্র জনগণ যাতে দেখতে পান, সেই ব্যবস্থাও করতে হবে এসএসসি কর্তৃপক্ষকে।

ষষ্ঠত, এসএসসিতে আইন ভেঙে নিয়োগ সংক্রান্ত চারটি মামলায় সিবিআই তদন্ত চালিয়ে যেতে পারবে বলে জানিয়েছে হাই কোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, প্যানেলের মেয়াদ শেষের পরে, সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে সিবিআই। প্রয়োজনে তাঁদের হেফাজতেও নিতে পারবে সিবিআই। তিন মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে সংশ্লিষ্ট আদালতে সিবিআইকে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছে দুই বিচারপতির বেঞ্চ।