কল্যাণ ঘোষ, আগরতলা : ত্রিপুরায় বিজেপি জোট জামানার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের নেতৃত্বে ভালো চলছিল স্বরাষ্ট্র দপ্তর এবং পুলিশ ব্যবস্থা। দীর্ঘ বাম শাসনের জং ধরা পুলিশ ব্যবস্থায় কোন ধরনের প্রতিহিংসা মূলক বদলি নীতি ছাড়াই স্বভাবগতভাবে পরিবর্তন আনতে পেরেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবই ত্রিপুরায় প্রথম নেশা বিরোধী অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ২৫ বছরে যে পুলিশ মাদক কারবারীদের মদত দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যকে নেশা কারকারীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিল, বিপ্লব জমানায় নেশা বিরোধী অভিযানে সেই পুলিশই ভারত শ্রেষ্ঠ পুলিশের গৌরব অর্জন করতে পেরেছে।
নেশা বিরোধী অভিযানে বিরাট সাফল্যের পাশাপাশি সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল বিপ্লব দেবের পুলিশ। বিপ্লব জমানায় রাজধানীতে চাঞ্চল্যকর অভিজিৎ পোদ্দার হত্যাকাণ্ড, বাধারঘাটে গুলি করে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ হত্যাকাণ্ড সহ বহু সংখ্যক জটিল খুনের মামলার তদন্তে পুলিশ দ্রুত সাফল্য দেখিয়েছিল। পুলিশ খুনের রহস্যভেদ করার পাশাপাশি খুনিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে পেরেছিল।
কিন্তু সেই তুলনায় মুখ্যমন্ত্রী অধ্যাপক মানিক সাহার শাসনে গত দুই বছরে ত্রিপুরা পুলিশ বদনাম ছাড়া তেমন কিছুই অর্জন করতে পারছে না। অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর অধ্যাপক ডক্টর মানিক সাহা সবকিছুতেই সরল এবং “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি”এই ধরনের সুবিধাবাদী মানসিকতা নিয়ে প্রশাসন চালাচ্ছেন । ইতিপূর্বে এই ধরনের সুবিধাবাদী মানসিকতা দেখা গেছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের শাসনে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অধ্যাপক মানিক সাহার এই সরল এবং সুবিধাবাদী মানসিকতার সুযোগ নিচ্ছেন পুলিশ সদর দপ্তরের একাংশ আইপিএস। অভিযোগ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা সম্পূর্ণভাবে পুলিশ সদর দপ্তরের একাংশ আইপিএস- এর মুষ্টি বদ্ধ হয়ে গেছেন।
সেই আইপিএস আধিকারিকদের একাংশ ত্রিপুরা পুলিশে প্রতিহিংসা এবং গোষ্ঠী বাজির নোংরা রাজনীতি করছেন। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ত্রিপুরা ক্যাডারের দক্ষ পুলিশ আধিকারিকদের গুরুত্বহীন করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে । পুলিশ সদর দপ্তরে গুঞ্জন রয়েছে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নাকি আইপিএসদের প্রাধান্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখতে চাইছেন। খবর ছড়ানো হয়েছে ত্রিপুরা পুলিশ ক্যাডারদের নাকি মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বাস করেন না। তাই গত কয়েক বছরে একাধিক নব্য আইপিএসকে প্রবেশন পিরিয়ড শেষ হওয়ার আগেই গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে। বহিরাগত যেসব পুলিশ আধিকারিক ত্রিপুরা সম্পর্কে কিছুই জানেন না কিংবা যাদের তদন্তগত কোন অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা নেই তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ার দিয়ে রাখা হয়েছে। এতে করে রাষ্ট্রপতি কালারর্স পদকপ্রাপ্ত পুলিশের কাজ বারোটা বেজে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ পশ্চিম জেলার এক আই পি এসকে নিয়েই পুলিশে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। পশ্চিম জেলার এই আই পি এস-র কোন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত দক্ষতা কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সাফল্য নেই ।
অথচ তিনিই রাজ্যের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিম জেলার পুলিশ সুপার পদে বহাল রয়েছেন। তার নেতৃত্বাধীন পুলিশ এখন চাঞ্চল্যকর দূর্গা প্রসন্ন দেব হত্যাকাণ্ডে ব্যর্থতা আগলে রেখে গোঁজামিল তদন্ত করে শেষ করতে চাইছে। অভিযোগ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পুলিশের একাংশ এখন প্রকাশ্যে সামাজিক অপরাধকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। জেলা পুলিশের একাংশ থানা গুলিকে মাসিক রোজগারের টার্গেট দিয়ে দিচ্ছেন। সেই টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে থানা স্তরে বেড়েছে মাদক কারবার, জমির দালালি, নিগোসিয়েশন মাফিয়াদের উৎপাত, জোয়ার আসর। এসব কিছুর প্রভাব পড়ছে সার্বিক আইনশৃঙ্খলার উপর। বাড়ছে দুর্গা প্রসন্ন দেব হত্যাকাণ্ডের মতো গ্যাং ওয়ারের ঘটনা। খুনের এবং বিভিন্ন অপরাধের মামলা হওয়ার পরও অভিযুক্তরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডক্টর মানিক সাহা সরল এবং সুবিধাবাদী মনোভাবের কারণে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা মাদক কারবারি এবং সমাজদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছেন না বলে অভিযোগ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরল সুবিধাবাদী মনোভাবকে পুঁজি করে ত্রিপুরা পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে খোদ পুলিশ মহলে সমালোচনা চলছে। অভিযোগ পুলিশ দপ্তর পরিচালনায় মুখ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতার জন্য খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত ‘নেশা মুক্ত ত্রিপুরা’ গড়ার আহ্বান রাজ্যে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে।
রাজ্যের অলি গলিতে এখন নেশা কারবারিদের উৎপাত। নেশার বাড়বাড়ন্তে প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে যুব সমাজ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবার। রাজ্যের গ্রাম পাহাড় তো দূরের কথা খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাড়ি এবং সরকারি বাড়ির কয়েক মিটার দূরত্বে পূর্ব থানার পেছনে এবং শিশু বিহার স্কুলের সামনেই ২৪ ঘন্টা ব্রাউন সুগারের কৌটা বিক্রি হচ্ছে। মাদক কারবারীদের অবাধ দৌরাত্ম সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন স্বরাষ্ট্র দপ্তর ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। সেই সাথে ব্যর্থতা রয়েছে নিগো বাণিজ্য এবং জমি মাফিয়াদের উৎপাত বন্ধ করার ক্ষেত্রে। অথচ সেই ব্যর্থতাকে চাপা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ত্রিপুরা পুলিশের বাহবা করে চলছেন। এতে করে রাজ্য পুলিশ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। মুখ্যমন্ত্রীর এই ধরনের নীতিতে খুশি নন সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে খোদ তার দলের একাংশ প্রাক্তন এবং বর্তমান মন্ত্রী বিধায়ক সহ নেতা নেত্রী। প্রসঙ্গত ২০২২ সালের মে মাসে স্বদলীয় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজের ঘরের লোকের অভিযোগের ভিত্তিতে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ত্রিপুরার জনগণের মুক্তির কান্ডারী হিসেবে পরিচিত বিপ্লব কুমার দেব।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চাপে বিপ্লব দেব মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার পাশাপাশি নিজের পছন্দের নিরিখে দলীয় সভাপতি তথা সজ্জন ব্যক্তি অধ্যাপক ডাক্তার মানিক সাহাকে মুখ্যমন্ত্রীর পদের জন্য বাছাই করেছিলেন। অভিযোগ সেই দায়িত্বভার নেওয়ার গত প্রায় আড়াই বছরে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর সহ পুলিশ প্রশাসন চালাতে গিয়ে তেমন কোন বিশেষ সাফল্য নেই মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার মানিক সাহার। গত আড়াই বছরে একটি দাঁতের হাসপাতাল ছাড়া ত্রিপুরার উন্নয়নে তেমন কোন নতুন কোন প্রকল্প গৃহীত কিংবা রূপায়িত হওয়ার হওয়ার খবর নেই। বিজেপি জোট জামানায় ত্রিপুরায় রাস্তাঘাট, স্মার্ট সিটি প্রকল্প, পর্যটন উন্নয়ন থেকে শুরু করে সমস্ত উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয়েছেন বিপ্লব জামানায়। বর্তমান সময়ে প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণে বিপ্লব জমানায় গৃহীত রাজ্যের একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।