বঙ্গ রাজনীতির রংবদল। এক দশক আগেও বাংলার মানচিত্রে গেরুয়া রং খুঁজতে হা-পিত্যেশ করতে হত। কিন্তু গত ১০ বছরে ভাগীরথী দিয়ে যেমন বহু জল গড়িয়েছে, তেমনই বঙ্গ রাজনীতির হালহকিকতেও বিস্তর বদল এসেছে। ধীরে ধীরে লাল রং ছাপিয়ে সবুজ হয়েছে বহু এলাকা, আবার বহু জায়গায় সবুজ ছাপিয়ে ছড়িয়েছে গেরুয়া আভাও।
২০১৪ লোকসভা নির্বাচন (Lok Sabha 2024) বাংলার রাজনীতিতে একপ্রকার ঐতিহাসিক নির্বাচন ছিল। সেটাই লোকসভার নিরিখে বঙ্গ রাজনীতির আঙিনায় বামেদের বিলুপ্ত হওয়ার শুরুয়াত। ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে যদি রাজ্যে পালাবদলের ইঙ্গিত মিলে থাকে, তাহলে ২০১৪-র লোকসভা রাজ্যে তৃণমূলের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার নির্বাচন। কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বামেরা। ইতিউতি উঁকি মারা শুরু করে বিজেপি।
এক দশক আগে বাংলায় নিজেদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩৪ আসন পায় তৃণমূল (TMC)। ২০০৯ সালের থেকে ১৫টি বেশি। গোটা জঙ্গলমহল ছেয়ে যায় সবুজ রঙে। উত্তরে মাত্র দুটি আসন যায় বিরোধীদের হাতে। সেবার দার্জিলিং থেকে জিতেছিলেন বিজেপির (BJP) এসএস আলুওয়ালিয়া। বিজেপি ২০১৪-এ চমকপ্রদভাবে দখল করে নেয় আসানসোল আসনটি। বাবুল সুপ্রিয়র হাত ধরে আসানসোলে জয়ই পরবর্তীতে বঙ্গ রাজনীতিতে বিজেপির উত্থানের গোড়াপত্তন করে দিয়ে যায়। ১৪’র ভোটে কংগ্রেস মালদহ ও মুর্শিদাবাদে নিজেদের গড় মোটামুটি ধরে রাখে। হাত শিবিরের দখলে যায় ৪ আসন। আর সিপিএমের হাতে পড়ে থাকে মাত্র দুই আসন। একটি রায়গঞ্জ। যেখানে জিতেছিলেন মহম্মদ সেলিম। আরেকটি মুর্শিদাবাদ, সেখানে কাস্তে হাতুড়ি তারা প্রতীকে জয়ী হন বদরুদ্দোজা খান।
পাঁচ বছর বাদে ২০১৯ সালে কার্যত পুরোপুরি বদলে যায় বাংলার ভোটচিত্র। মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে যায় লাল রং। সবুজ এবং গেরুয়ার সহাবস্থানের মাঝে টিম টিম করে জ্বলতে থাকে কংগ্রেসের নীল। উনিশের ভোটে শুধু বাংলায় বামেরা (Left Front) কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে যায় সেটাই নয়, একই সঙ্গে চমকপ্রদ উত্থান হয় বিজেপির। গোটা উত্তরবঙ্গ রাঙিয়ে যায় গেরুয়া রঙে। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, রায়গঞ্জ, মালদহ উত্তর লোকসভা কেন্দ্র চলে যায় বিজেপির দখলে। জঙ্গলমহলের রংও হয়ে যায় গেরুয়া। বাঁকুড়ার দুই আসন, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামে ফোটে পদ্ম।
মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রটিও দখল করে গেরুয়া শিবির। মধ্যবঙ্গে মতুয়াগড় এবং বারাকপুরও যায় গেরুয়া শিবিরের দখলে। আসানসোল, বর্ধমান-দুর্গাপুর শিল্পতালুকেও সবুজ রংকে ছাপিয়ে যায় গেরুয়া। হুগলিতে পদ্ম ফোটান লকেট চট্টোপাধ্যায়। সব মিলিয়ে বাংলায় বিজেপির দখলে চলে যায় ১৮ আসন। বহরমপুর এবং মালদহ দক্ষিণ আসন দুটি যায় কংগ্রেসের দখলে। আর তৃণমূল মূলত কলকাতার আশেপাশে এবং দক্ষিণবঙ্গের ২২টি আসন জেতে।
এর পরও বাংলায় জনা দুয়েক সাংসদ দল বদলেছেন। দেশে যখন অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হল তখন খাতায় কলমে কার্যত একই জায়াগায় ছিল তৃণমূল এবং বিজেপি। ২৪-এ কী হবে? বাড়বে গেরুয়ার প্রভাব? নাকি পদ্ম মুছে ঘাসফুল ফুটবে বাড়তি কোনও আসনে? বামেরা ফিরবে বাংলার ভোট মানচিত্রে? নিজেদের শেষ সম্বল মালদহ দক্ষিণ ও বহরমপুর ধরে রাখতে পারবে কংগ্রেস? সব জবাবের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৪ জুন পর্যন্ত।