নিজস্ব সংবাদদাতা | গোপাল সিং | ত্রিপুরা
অধিকংশ স্কুলেই ষান্মাসিক (টার্ম-ওয়ান) পরীক্ষার ফলাফল বা পরীক্ষায় কত নম্বর পেল শিক্ষার্থীরা? সেটা সম্পূর্ণ জানার আগেই ঘোষনা হয়ে গেল ‘পিরিয়ডিক টেষ্ট-২’ এর দিন-তারিখ! সিলেবাস অনুযায়ী প্রচুর চাপ্টার! সময় পেলো মাত্র ২ মাস! মাঝে কেটেছে শারদোৎসবের দিন।
ত্রিপুরা রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের কার্যকলাপ এখন রাজ্যবাসীর কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন নয়, বরং অনিয়ম, উদাসীনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠছে দিন দিন। বিদ্যাজ্যোতি প্রকল্পের আওতাধীন ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে কেন্দ্রীয় NCERT ও CBSE নির্দেশিকা পুরোপুরি উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নির্দেশিকা অনুযায়ী, শিক্ষাবর্ষে চারটি নির্দিষ্ট সময়ের পরীক্ষা নেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নির্দিষ্ট সময়ে নেওয়া হচ্ছেনা বলে অভিভাবকমহলে জোড় জল্পনা চলছে। দেখা যাচ্ছে, ‘পিরিয়ডিক টেস্ট-২’ জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে হওয়ার কথা থাকলেও, অধিকাংশ বিদ্যালয়ে তা নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই শুরু করা হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের আগাম জানিয়ে দেওয়া হলেও এই তারিখ পরিবর্তন কেন এবং কার অনুমতিতে — তা নিয়ে কোনো সঠিক ব্যাখ্যা মেলেনি শিক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার শিক্ষা দপ্তরের কিছু অনিয়ম প্রকাশ্যে আসার পরও শিক্ষা দপ্তর নির্বিকার। গোটা বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রী কেন কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না— প্রশ্ন অভিভাবক মহলে। এদিকে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের সংশোধিত সিলেবাস আজও SCERT–এর ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়নি। পুরনো সিলেবাসে নতুন বছরের নাম জুড়ে দিয়ে, ভুলভ্রান্তিতে ভরা সিলেবাসই চালানো হচ্ছে। ফলে স্কুলগুলোতে শিক্ষকরা বা প্রধান শিক্ষক নিজের মতো করে সিলেবাস প্রকাশ করছেন পরীক্ষার কয়েকদিন আগে।
শিক্ষক-ছাত্র অনুপাতও এখন রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার দুরবস্থার বড় প্রমাণ। খোয়াই সরকারী ইংরেজী মাধ্যম বিদ্যালয়ে ২০-২৫ জন শিক্ষক রয়েছেন, কম্পিউটার, নাচ, গান, নাটক ও চিত্রাঙ্কন বিভাগে অস্থায়ী শিক্ষক ধরলে সেটা ৩০-৩২ জন হবে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে নিয়মিত সব বিষয়ে পাঠদান হয়না। কোনো কোনো শিক্ষক নিয়মিত স্কুলে আসেননা। অপরদিকে খোয়াই সরকারী দ্বাদশ শ্রেণি বিদ্যালয় একই সাথে বিদ্যাজ্যোতি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রাথমিক বিভাগ সহ গোটা বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতার জন্য নিয়মিত ক্লাস চালানো সম্ভব হচ্ছেনা। একই দূরবস্থা খোয়াই সরকারী দ্বাদশ শ্রেণি বালিকা বিদ্যালয়েও। একসাথে কয়কটি ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের একত্রিত করে ক্লাস নিতে হচ্ছে।
অপরদিকে, মুঙ্গিয়াকামি ব্লকের অধীনে বিভিন্ন বিদ্যালয় সহ তেলিয়ামুড়া মহকুমার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ১৫ থেকে ৩০ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য রয়েছেন ৫ থেকে ১০ জন শিক্ষক! অন্যদিকে অনেক বিদ্যাজ্যোতি অনুমোদিত ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে এবং গ্রামীণ এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নেই বললেই চলে। ফলে একদিকে অযথা শিক্ষক আধিক্য, অন্যদিকে শিক্ষক সংকট— এই বৈষম্যই রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের পরিকল্পনাহীনতার স্পষ্ট প্রতিফলন।
বিদ্যাজ্যোতি প্রকল্পের ঘোষণার পর আশার আলো দেখা দিলেও, উপযুক্ত শিক্ষক, পর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং গুণগত মানের শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় প্রকল্পটি এখন কাগজেই সীমাবদ্ধ। শিক্ষা দপ্তরের একাংশের মতে, “যেদিন পর্যাপ্ত যোগ্য শিক্ষক এবং আধুনিক পরিকাঠামো তৈরি হবে, সেদিনই এই প্রকল্পের আসল সুফল পাবে রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা।”
এছাড়া গুরুতর অভিযোগ উঠছে, খোয়াই জেলার একাধিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস হয়না, বিশেষ করে অঙ্ক ক্লাস হয় না— এমন তথ্যও সামনে এসেছে। শিক্ষকদের মধ্যে চলছে দায়িত্ব ঠেলাঠেলি, কেউই অঙ্ক ক্লাস নিতে চান না। শহরের নামী বিদ্যালয় থেকে শুরু করে গ্রামীণ এলাকার বাংলা মাধ্যম স্কুল— সর্বত্র একই চিত্র।
অভিভাবকদের অভিযোগ, “নিয়মিত ক্লাস হয় না, শিক্ষকরা অনিয়মিত, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে দেরি — এসবের কোনো দায় নিচ্ছে না শিক্ষা দপ্তর।” পরিস্থিতি এমন যে, খোয়াইয়ের বহু বিদ্যালয়ে ‘ষান্মাসিক পরীক্ষা’র ফলাফল প্রকাশের আগেই ঘোষণা করা হয়েছে ‘পিরিয়ডিক টেস্ট-২’-এর সময়সূচি!
এরই মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে ১০৩২৩ চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের বিষয়টিও। এই শিক্ষকদের অভিজ্ঞতাকে শিক্ষা দপ্তর এবং রাজ্য সরকার অনায়াসে কাজে লাগিয়ে বিকল্প ভাবনা করতে পারতো বলে অভিমত চাকুরিচুত শিক্ষকদের। তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশা হতোনা বলেও তাদের দাবি। এছাড়া রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা নজরে রেখে ২১ মাস তাদেরকে দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা গিয়ে থাকে তবে সেটা পরবর্তী সময়েও রাজ্য ক্যাবিনেট করতো পারতো বলেও তাদের দাবি। ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের যে মানোন্নয়ন হয়েছিল তা সরকারি রেকর্ডেই রয়েছে বলে তারা দাবি করছেন। ১০৩২৩ চাকুরীরত অবস্থায় রাজ্যজুড়ে ‘সাধনা-প্রেরণা’ সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়েছিল বলেও তাদের দাবি।
শিক্ষা, রাজনীতি ও প্রশাসনের সমন্বয়ে যে রাজ্যের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষাগত ভিত্তি গড়ে উঠবে, ত্রিপুরার শিক্ষা দপ্তরের এই ভুতুড়ে কার্যকলাপ তাতে এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছে।


