সুমন সেন, কলকাতা : কলকাতা হাই কোর্টের বিশেষ বেঞ্চের রায়ে চাকরি গিয়েছিল যাঁদের, তাঁদের চাকরি আপাতত বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট। তবে ‘আপাতত’। এ ব্যাপারে হাই কোর্ট যে রায় দিয়েছিল তাতে স্থগিতাদেশ দিয়ে দেশের শীর্ষ আদালত জানিয়ে দিল, আগামী ১৬ জুলাই এ সংক্রান্ত পরবর্তী শুনানি হবে। ‘প্রমাণিত অযোগ্যদের’ বেতনের টাকা ফেরতের রায়েও অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। কিন্তু, এই মামলার চূড়ান্ত রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্য-অযোগ্য বাছাই এবং বাছাইয়ের সূত্র যে গুরুত্বপূর্ণ, তা-ও শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ।
দুর্নীতি’র অভিযোগে ২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুরো প্যানেলটিই বাতিল করেছিল কলকাতা হাই কোর্ট। তাতে চাকরি যায় ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীর। পাশাপাশি, যাঁরা ‘সাদা খাতা’ জমা দিয়ে কিংবা মেয়াদ উত্তীর্ণ সময়ে চাকরি পেয়েছেন, সেই ‘অযোগ্য’দের সুদ সমেত বেতন ফেরানোর নির্দেশও দিয়েছিল হাই কোর্ট। এ ছাড়া ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ নতুন চাকরি দিতে রাজ্য মন্ত্রিসভা যে সুপারনিউমেরারি পদ তৈরি করেছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে হাই কোর্ট।
এই সিদ্ধান্তের জন্য সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে। রায়ে বলা হয়েছিল, সিবিআই প্রয়োজন মনে করলে মন্ত্রিসভার কোনও সদস্যকে এই তদন্তে হেফাজতে নিয়েও জেরা করতে পারবে। গত ২৯ এপ্রিলের শুনানির পরে, মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে এই তদন্তে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই আদেশও মঙ্গলবার বহাল রাখা হল। হাই কোর্টের রায়ের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ দেওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবারের নির্দেশের পর মমতা এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে লেখেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টে ন্যায় প্রাপ্তির পর আমি বাস্তবিকই খুব খুশি এবং মানসিক ভাবে তৃপ্ত। সামগ্রিক ভাবে শিক্ষক সমাজকে জানাই আমার অভিনন্দন এবং মাননীয় সুপ্রিম কোর্টকে জানাই আমার
মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, হাই কোর্টের চাকরিবাতিলের নির্দেশে স্থগিতাদেশ দিচ্ছে তারা। কেন এই নির্দেশ, তার ব্যাখ্যা করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ বলে, ‘‘যদি যোগ্য এবং অযোগ্য আলাদা করা সম্ভব হয়, তা হলে গোটা প্যানেল বাতিল করা ন্যায্য হবে না।’’ স্থগিতাদেশ থাকবে বেতন ফেরানোর নির্দেশেও। তবে চাকরি বহাল রাখলেও এই ২৫,৭৫৩ জনকেই ‘মুচলেকা’ দিতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়েছে, এ ক্ষেত্রে পরে যাঁদের নিয়োগ ‘অবৈধ’ বলে প্রমাণ হবে, তাঁদের প্রত্যেককে টাকা ফেরত দিতে হবে।
এরই পাশাপাশি, সুপারনিউমেরারি পদ তৈরি করা নিয়ে বাংলার মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে যে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তাতেও স্থগিতাদেশ বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। আদালত জানিয়েছে, সিবিআই তদন্ত করতে পারবে ‘অবৈধ নিয়োগ’ সংক্রান্ত অন্য মামলাগুলি নিয়ে। তবে তদন্ত করলেও কড়া পদক্ষেপ করতে পারবে না কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। আপাতত এই সংক্রান্ত পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে আগামী ১৬ জুলাই। অর্থাৎ লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের এক মাস ১২ দিন পর আবার শুনানি হবে এসএসসির ‘চাকরি বাতিল’ সংক্রান্ত মামলার। তবে হাই কোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দিলেও সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে হাই কোর্টের রায়ে ভুল ছিল না।
হাই কোর্টের রায় ‘যথার্থ’
মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের যে সিদ্ধান্ত কলকাতা হাই কোর্ট নিয়েছিল, তা যথার্থ। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ বলেছে, ‘‘হাই কোর্টের রায় সম্পূর্ণ ঠিক এবং সন্দেহাতীত। চাকরি খারিজের যে সিদ্ধান্ত হাই কোর্ট নিয়েছিল, তা বৈধ।’’ কারণ ব্যাখ্যা করে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ‘‘যে দুর্নীতি হয়েছে, তা যে ভবিষ্যতে আর হবে না, তা কে বলবে? এ ব্যাপারে রাজ্য বা এসএসসি কেউই এমন পর্যায়ে নেই যে, এই বিষয়টি নিশ্চিত করে বলতে পারে। সে ক্ষেত্রে হাই কোর্টের সিদ্ধান্তে তো কোনও ভুল নেই। নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে হাই কোর্ট যা রায় দিয়েছে তা যথার্থ।’’
হোঁচট যোগ্য-অযোগ্য যুক্তিতে
হাই কোর্ট যদি সন্দেহাতীত হয়, তবে স্থগিতাদেশ কেন? সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, তার কারণ ‘‘যোগ্য এবং অযোগ্য বাছাই করা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’ আদালত বলেছে, ‘‘পৃথকীকরণ যদি সম্ভব হয় তবে শুধু তাঁদের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ করা হোক যাঁদের বিরুদ্ধে আসল অভিযোগ।’’ এ নিয়ে এসএসসি, রাজ্য এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বক্তব্যকেও গুরুত্ব দিয়ে শুনেছে সুপ্রিম কোর্ট।